আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে

#আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে 

#লেখনীতে_সালমা_চৌধুরী 

#পর্বঃ০৫


আবির মায়ের উদ্দেশ্যে ঠাট্টার স্বরে  বলে উঠলো,

 'এর উল্টোটাও হতে পারে  যেমন তোমার বউমা তোমার কোলে ঘুমিয়ে গেলো আর তুমি তাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে আমার জন্য অপেক্ষা করলে' 


ছেলের এরকম ঠাট্টায় ভ্যাবাচেকা খেলেন মালিহা খান৷  


'আবির পুনরায় শান্ত অথচ ক*ড়া বলে উঠলো, 'কাল থেকে তোমায় যেন বসে থাকতে না দেখি।  আমার কিছু লাগলে চেয়ে নিবো আর খাবার টেবিলে রেখে দিও আমি খেয়ে নিব। '


 এই কথার কোনো উত্তর বা দিয়ে,মালিহা খান স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, 


'তানভির, মেঘ এখনও খায় নি, একটু ডেকে আসবি? এখন খাবে কি না!' 


তানভির ঠিক আছে বলে উপরে গেলো, আবিরও নিজের রুমে গেলো৷ ৫ মিনিটে ড্রেস পাল্টে  ফ্রেশ হয়ে নিচে নামছে। 


এতক্ষণে মেঘ খাবার টেবিলে চলে এসেছে৷  ভেবেছিল ভাই ফ্রেশ হয়ে নামার আগে তাড়াতাড়ি খেয়ে পালাবে৷  


খাওয়া অর্ধেক হতেই  তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সিঁড়ির পানে, কালো টিশার্ট আর টাওজার পরে হাতে মোবাইল নিয়ে আপন মনে নামছে আবির, মেঘ সরু চোখে নিরীক্ষণ করছে আবিরকে৷  মানুষটাকে দেখে হৃৎস্পন্দন বাড়তে লাগলো মেঘের৷   এখন সে স্পষ্ট অনুভব করছে। তার বুকের ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে ।  কিন্তু বোধগম্য হলো না কি হচ্ছে। নিজের অজান্তেই বুকের বা পাশে হাত রাখলো মেঘ। অনুভব করলো কিছু একটা  অনবরত নৃত্য করছে বুকের ভেতর৷


আবিরের চেয়ার টেনে বসার শব্দে ঘোর কাটলো মেঘের, স্ব বেগে হাত নামিয়ে আনলো বুক থেকে,  আবির মেঘের ঠিক বিপরীত চেয়ারটায় বসেছে।  

মেঘের ছোট্ট বুকটা অনবরত  কেঁপেই যাচ্ছে,  চোখ তুলে তাকাতে পারছে না মেয়েটা।  শরীর কাঁ*পা কাঁ*পি  আর হৃদপিণ্ডের লাফা- লা*ফিতে সে বিদ্বিষ্ট,  দিশেহারা অবস্থা অষ্টাদশীর।  ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যেতে আবিরের সামনে থেকে৷  কিন্তু পারছে না মনে হচ্ছে পায়ে শিকল দিয়ে বাঁধা। 


 মালিহা খান,   হঠাৎ মেঘের হাতে হালকা ধাক্কা দিলেন, 'কিরে কি হলো তোর?'


দ্বিতীয় বার বার ঘোর কাটলো মেঘের,  তৎক্ষণাৎ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো, কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, 'কিছু না!' 


এই বলে পুনরায় খাওয়ার চেষ্টা করলো,কিন্তু এবার আর গলার দিয়ে খাবার নামছে না মেঘের৷  গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে,  কাঁ*পা কাঁ*পা হাতে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে অর্ধেক গ্লাস পানি নিমিষেই শেষ করে ফেললো মেঘ। 


আবির আপন মনে খাচ্ছে,  'সামনে বা আশেপাশে কি হচ্ছে এসব দেখার প্রয়োজনই মনে করলো না সে।  এই জগতের সবকিছু  তার আগ্রহ সৃষ্টি  করতে অক্ষম। '


আবিরের গা ছাড়া ভাব দেখে কিছুটা  স্বাভাবিক হয়ে খাওয়া শুরু করে মেঘ৷ মাঝখানে এক পলকের জন্য তাকিয়েছিল আবিরের দিকে, 'কালো টিশার্টে মুখ টা কত মায়াবী লাগছিল, এলোমেলো চুল, খাওয়ার স্টাইল দেখে দ্বিতীয় বারের মতো ক্রাশ খেলো  অষ্টাদশী।  


কে বলতে পারে, দুইদিন আগে পর্যন্ত আবিরের কোনো স্মৃতি ছিল না  মেঘের মন, মস্তিষ্ক জোড়ে।  হঠাৎ মনে পরলেও শুধু ওকে মেরেছিল এই স্মৃতিটায় মনে হতো আর রাগে কটমট করতো মেঘ। আর আজ বিকাল থেকে যতবার আবিরকে দেখছে ততবার  মেঘের শীর্ণ বক্ষ ধরফড়িয়ে ওঠছে।  ছোট বেলা যে ভ*য়টা ভাইয়ের প্রতি বোনের ছিল সেটা আজ বদলে গেছে।  আবিরের দৃষ্টি তাকে বরফের  ন্যায় জমিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত৷  এই দৃষ্টিতে  সূ*চালো  কিংবা ধা*রালো অ*স্ত্র  আছে যা এক কিশোরীর বক্ষপিঞ্জর এফোঁ*ড়  ওফোঁ*ড়  করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে৷


আবিরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাবিজাবি চিন্তা করছিল  মেঘ। 


আবির চোখ তুলে তাকাতেই, মেঘের মনোযোগ ঘুরে গেলো, আবিরের ত*প্ত  দৃষ্টি  মনে হচ্ছে ফা*লা ফা*লা  করে দিচ্ছে হৃদপিণ্ডটা, দৃষ্টি সংযত করে চিবুক নামিয়ে নিলো গলায়, সহসা মুখবিবর চুপসে গেছে আমস*ত্ত্বের ন্যায়। 


দ্বিতীয়বার আবিরের দিকে তাকানোর স্পর্ধা টুকু  হয় নি অষ্টাদশীর। 


এরমধ্যে মালিহা খান ছেলে আবিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

  'তোর নতুন কোম্পানি টা কি না খুললে হয় না? তোর বাবা বিষয়টা ভালোভাবে নিচ্ছেন না।  কেনো বাবাকে রাগিয়ে দিচ্ছিস..!! তোর বাবা তোকে অনেক ভালোবাসে। '


শাণিত স্বরে মায়ের দিকে তাকিয়ে  আবির বলা শুরু করলো,


"ছেলেরা সারাজীবন বাবাদের প্রিয় থাকতে পারে না। 

 নিজের স্বপ্ন,ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দূরত্ব বেড়ে যায় বাবা ছেলের।

 এটা অস্বাভাবিক কিছুনা। যদি বাবার  স্বপ্ন বা ইচ্ছের হাল প্রতিটা ছেলে ধরতো তাহলে পৃথিবী এতটা এগিয়ে যেতো না, আমাকেও দেশ ছেড়ে এত বছর বাহিরে পড়ে থাকতে হতো না। আব্বু নিজে এই কোম্পানি শুরু করেছিল,  ওনি যদি  ওনার বাবার ইচ্ছেকে প্রাধান্য  দিতেন তাহলে আজ এতদূর পৌছাতেন না ।  তাছাড়া আমি তো বলি নি বাবার স্বপ্ন বাদ দিয়ে আমি আমার স্বপ্নকে প্রাধান্য দিবো। আমার স্ব*প্ন একান্তই আমার।  আমি দুদিক ই সামলাবো  তুমি এসব নিয়ে অযথা চি*ন্তা  করে নিজের শরীর খারাপ করো না।'


মালিহা খান চিন্তিত স্বরে বলে উঠলেন, 'এত চাপ  আর দৌড়াদৌড়ি করে তো নিজে অসুস্থ হয়ে পরবি বাবা।'


আবির গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, "তোমাকে তো বললাম আমার জন্য দুশ্চি*ন্তা করতে হবে না।"


তানভির মাঝখান থেকে বলে উঠলো,  "ভাইয়ার জন্য চি*ন্তা করার মানুষ  আছে বড় আম্মু,  তুমি রিলা*ক্সে থাকতে পারো।"


মেঘ এতক্ষণ নিরবে খেলেও এই কথা শুনামাত্রই ছোট দেহ কম্পিত হয় তার, আত*ঙ্কিত হয়ে  তাকালো আবিরের দিকে,


আবির তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তানভিরের দিকে,  ওমনি মুখটা চুপসে গেলো তানভিরের৷


করুন স্বরে বললো, 'সরি ভাই'


পিনপতন নীরবতা খাবার টেবিলে।  কেউ কোনো কথা বলছে না।  মেঘের মনটা সহসা খারাপ হয়ে গেলো৷ 


"তানভির আবিরের একনিষ্ঠ ভক্ত । এক কথায় দুজন দুজনের  বেস্ট ফ্রেন্ড।  আবির গুরুগম্ভীর স্বভাবের, রাগী, কথা কম বলে কিন্তু দিনশেষে আবিরের  অপ্রকাশিত আবেগগুলো তানভিরকেই শেয়ার করে এসেছে এতবছর,এমনকি এখনও। আবিরের থেকেও বেশি তানভির ভালোবাসে আবিরকে। আবির যদি বলে সারারাত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবি, তানভির তাই করবে। 


অবশ্য করবে নাই বা কেনো, সেই কলেজ লাইফ থেকে রাজ*নীতি করার ইচ্ছে তানভিরের, পড়াশোনাতে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না ।  বড় আব্বু এবং আব্বুকেও বলেছে কয়েকবার তাদের কড়া জবাব, রাজ*নীতি আমাদের পছন্দ না.  এই বাড়ির কেউ রাজ*নীতি করবে না।


একদিন বাধ্য হয়ে ভাইকে কল করেছে তানভির,  ভালোমন্দ কথা শেষ করে তানভির  ভয়ে ভয়ে বললো, 


'ভাইয়া তোমার সাথে আমার একটু কথা ছিল!'


আবির সাবলীল ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিল সেদিন, 

 'রাজ*নীতি করতে চাস তাই তো?'


তানভির নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, আবির  এত স্বাভাবিক ভাবে  কথাটা বলছে'


আবির: 'তুই রাজ*নীতি কর সমস্যা নাই।  কিন্তু কিছু বিষয় মাথায় রাখবি, বিষয় টা দেখতে যতটা সহজ ততটাও সহজ না।  একনিষ্ঠ এবং সৎ থাকতে হবে তোকে ।   দল,মত নির্বিশেষে তোকে সত্যের পথে চলতে হবে  পা চা*টা স্বভাব যেনো না হয়। '


তানভির ভয়ে ভয়ে বললো, 'বড় আব্বু আর আব্বু তো রাজি হচ্ছে না'


আবির  হেসে উত্তর দিয়েছিল,  'ঐসব আমি সামলে নিবে, তুই আমায় কথা দে তুই তোর জায়গায় সৎ থাকবি, আর যেকোনো সমস্যা আমায় শেয়ার করবি'


সেদিন খুশিতে তানভিরের  চোখ টলমল করছিল,  আবির সামনে থাকলে হয়তো জরিয়ে ধরে কেঁ*দে দিতো ছেলেটা, সেদিনই ভাইকে কথা দিয়েছে, '

'সে সারাজীবন সৎ থাকবে এবং একনিষ্ঠ ভাবে রাজ*নীতি করবে। '


এরপর থেকে রাজ*নীতি  সম্পর্কিত যত ঝামেলা আছে,  কি করা দরকার, কোনটা করলে ভালো হবে সবই ভাইয়ের সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তানভির । 


 আজ সে  ছাত্রলী*গের সহ-সভাপতি। সবটুকু ক্রেডিট আবিরের।   আগামীবছর মে*য়র নির্বাচনের পরে  নতুন করে সভাপতি করা হবে।  তাই তানভির চেষ্টা করছে যেন এইবার সভাপতি হতে পারে৷ '


তানভিরের রাজ*নীতির  জন্য বাবা-চাচার সাথে আবিরের কথা-কাটাকাটি সেই শুরু থেকেই।  কিন্তু আবিরের এক কথা,  তানভির রাজ*নীতিই করবে।  আজ সন্ধ্যায় ও  বাবা-চাচার মুখের উপর বলেছিল তানভিরকে কোনো প্রকার বাঁধা যেনো না দেয়া হয়। 


তানভিরের জীবনে আবির গাছের ন্যায়, যার ছায়ায় তানভিরের অবস্থান।  ভাই ছাড়া তানভির অসহায় । 


★★★


খাওয়া শেষ করে আবির নিজের রুমে চলে গেছে, তানভির ও চলে গেছে।  কিন্তু বসে আছে মেঘ,  সে খাবার টেবিলে সবার আগে এসেছিল, ভেবেছিল ভাইয়ের আগে খেয়ে পালাবে কিন্তু তা আর হলো কই আবিরের জীবনে কেউ আছে এই কথাটায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অষ্টাদশীর,  ভাতের প্লেটে আঙুল ঘুরাচ্ছে আর ভাবছে, 


'আমার ছোট্ট মন টা এভাবে ভেঙে গেলো, প্রেমে পরার আগেই ব্রেকাপ হয়ে গেলো, ছিঃ' তৎক্ষনাৎ  নিজের মনকে নিজেই সান্ত্বনা দিচ্ছে,  থাক মন খারাপ করিস না, ছেলেটা ভালো না,মনে নেই তোকে ছোট বেলা মেরেছিল, আস্ত হিট*লার, তোর জীবনে রাজপুত্র আসবে যার জীবনে রাজ করবি শুধু তুই,' 


মালিহা খান মেঘের হাতে পুনরায় ধাক্কা দিয়ে বললো, থাক তোর আর খেতে হবে না, এতে হুঁশ ফিরে মেঘের৷ 


মেঘ কিছু বলার আগেই খাবারের প্লেট সামনে থেকে নিয়ে যান ওনি।  বড় আম্মুর এসব কর্মকাণ্ডে আহাম্মক বনে যায় মেঘ।  


মালিহা খান বলে উঠেন: এভাবে ১৪ ঘন্টা ভাত নিয়ে বসে থাকলে বি*ষ হয়ে যাবে খাবার। 


মেঘেরও খাবার খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই আর।  সে তো নিজেকে সা*ন্ত্বনা দিতে ব্যস্ত।   হাত টা ধৌয়ে রুমের দিকে যাচ্ছে।  মালিহা খান মেঘকে ডেকে আবার বললেন তোর কি পেট ভরেছে নাকি নতুন করে খাবার দিব তোকে,  


আর খাবো না' এটুকু বলে রুমে চলে আসে মেঘ । পড়তেও ইচ্ছে করছে না মেয়েটার,  চুপচাপ শুয়ে আছে। 


চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠে,  'আবিরের হাসি, বাইক এনে যখন হাসি মুখে বলছিল কথা গুলো কানে ভেসে আসছে, কি সুন্দর করে কথা বলে মানুষ টা, তাকানোর ধরন, রাগলে কুঁচকে ফেলা ঘন ভ্রু দুলো  সবই যেনো চোখের সামনে ভাসছে মেঘের। '


 সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেলে মেঘ,  বুক ভে*ঙে আসে কষ্টে৷  এই লোক আমার ভাবনায় কেনো আসছে বার বার, এই লোক তো অন্য কারো৷  এই বলে অভিমানে ঘুমিয়ে পরে মেঘ।


★★★


আজ শুক্রবার সকালে থেকে বাড়িতে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে।  মীম, আদি আর মেঘ দুষ্টামি, আড্ডায় মাতিয়ে তুলেছে  ড্রয়িংরুম। 


তিন ঝা রান্নায় ব্যস্ত।  আবির বাড়ি ফিরেছে বলে আবিরের দুই মামা, দুই খালা তাদের বাচ্চারা সবাই দেখতে আসবে,   মীম আর মেঘের মামা,খালাদের বাড়ি থেকেও বেড়াতে আসবে মানুষ।     বেশিরভাগ মানুষ ই চাকরিজীবী যার ফলে শুক্রবার ছাড়া কারও সময় নেই।  ইকবাল খান ব্যস্ত বাজার করা নিয়ে৷  যখন যা লাগছে ওনি ছুটছেন আনার জন্য।  


তানভিরের সকাল থেকে কোনো খোঁজ নেই, সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছে,  পার্টি অফিসে কাজ আছে, বিকালে ফিরবে বলে চলে গেছে। এজন্য মেঘের কোনো ভয় ডর নেই।  আপন মনে আড্ডায় মগ্ন মেয়েটা।  


হঠাৎ  উপরে করিডোর  থেকে আবির ডাক দিলো মাকে, 'আম্মু একটু কফি দিতে পারবে'


এই বলে রুমে চলে গেলো পুনরায়, 

"উত্তর শুনারও প্রয়োজন মনে  করে নি সে । "


মালিহা খান কফি করে মেঘকে ডাক দিলেন, 'কফি টা আবিরকে দিয়ে আয় তো মা!'


তৎক্ষনাৎ মেঘের মনে পরে গেলো গতরাতে কথা, সহসা বলে উঠলো,  আমি কেনো মীম দিয়ে আসুক৷  


মালিহা খান কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো, ওরা নিলে ফেলে দিবে, তখন আরেক মুসিবতে পড়বো,  বাড়িতে একটু পর মেহমান আসবে যা না মা।  


মেঘ আর কথা না বাড়িয়ে ধীর পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আবিরের দরজা পর্যন্ত আসলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে মেঘের, বুকের ভেতরের ধুকপুক টা বেড়ে যাচ্ছে ,  হাত- পা কাঁপছে।  আস্তে আস্তে দরজায় টুকা দিলো মেঘ


আবির: দরজা খুলা আছে


কাঁ*পা কাঁ*পা হাতে দরজা ধাক্কা দিলো মেঘ। 

আবির ল্যাপটপে কি যেনো করছে।  তাকিয়েও দেখলো না কে এসেছে।  


আবির: এখানে রেখে যা 


মেঘ  হাঁটতে পারছে না, হাত আরও বেশি কাঁপছে এখন, পায়ে একটুকু  জোর পাচ্ছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে  আছে আগের জায়গায়


আবির ল্যাপটপ টেবিলে রেখে মেঘের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে,  হাত থেকে কফির কাপ টা নিয়ে  ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখে,   মেঘের সেদিকে কোনো মনোযোগ নেই,  তার মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরন ছুটছে এদিক সেদিক। বডিস্প্রের তীব্র  ঘ্রাণে হুঁশে ফেরে মেঘ,  তার থেকে এক ফুটের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে আবির, 


আচমকা এইভাবে এসে দাঁড়ানোয়  একটু ভ্যাবাচেকা খেলো মেয়েটা। মেঘ ত্রস্ত  ঘুরে গেলো নিজের উপর জোর খাটিশে পা বাড়ায় দরজার দিকে।  


সবেগে,সুদূর হস্তে মেঘের  কনুই চেপে ধরলো আবির, কড়া কন্ঠে বললো,


'এদিকে তাকা'


অনিচ্ছা স্বত্তেও ঘুরে দাঁড়ালো মেঘ।  চিবুক নেমে গলায় আটকালো, সারা শরীর কাঁপছে, শীতল স্বরের হুমকিতে কানের লতি গরম হয়ে যাচ্ছে সাথে আবিরের শরীরের আর বডিস্প্রের  তীব্র  গন্ধ  নাকে লাগছে মেঘের।  


আবির পুরু কন্ঠে বলল, 'কফিটা টেবিলে দিয়ে আসতে বলেছিলাম কথা কানে যায় না?'


এতটুকু বলতেই মেঘ হেলেদুলে পড়ে যেতে নেয়,


টালমাটাল মেয়েটার বাহু ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলো আবির, জ্ঞান হারাতে হারাতেও যেন হারায় নি মেঘ,


আবিরের চাউনীতে তীক্ষ্ণতা গম্ভীর কন্ঠে বললো, 'তুই কি পুষ্টিহীনতায় ভুগছিস? অবশ্য ভুগবি নাই বা কেন, খাবার প্লেটে আঙুল ঘুরালে কি আর শরীরে পুষ্টি হবে!'


প্রথমে গম্ভীর কন্ঠে বললেও শেষটা যেনো মজার ছলেই বললো।।  


মেঘের শরীর ঘামছে, কে বুঝাবে এই লোকটাকে, যাকে দেখলে অষ্টাদশীর সব শক্তি নিমিষেই মিলিয়ে যায় কোথায়  যেন, যার দৃষ্টি  কেঁ*ড়ে  নেয় তার সমস্ত ধ্যান-জ্যান,মনোনিবেশ।  


আবির সাবলীল ভঙ্গিতে বলে উঠলো, 'যেতে পারবি নাকি দিয়ে আসবো?'


নিজেকে সামলে মেঘ বললো,'পারবো৷ তারপর গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় মেঘ!'


আবির তাকিয়ে আছে অষ্টাদশীর হাঁটার পানে। 


মেঘ কোনোরকমে নিজের রুম পর্যন্ত এসেছে,এক দৌড়ে এসে খাটে শুয়েছে, মন মস্তিষ্ক  অস্বাভাবিকভাবে লাফালাফি করছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব খোঁজে পেলো না।  সেন্স হারিয়ে পরে আছে বিছানায়।  


★★★ 


১১ টার পর থেকে মেহমান আসা শুরু হয়েছে।  বাড়িঘর ভরে গেছে আত্মীয় স্বজনে।  মীম, আদি গোসল করে সেজেগুজে গল্প করছে সবার সাথে, আবির একেবারে নামাজের সময় ঘর থেকে বের হয়েছে। টুপি, পাঞ্জাবি পড়ায় অন্যান্য দিনের থেকেও অনেক সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে।  


সবাইকে সালাম দিয়ে টুকটাক কথা বলে মামাদের সাথে বেরিয়ে যায় নামাজ পরতে।। 


মেঘের দেহ এখনও বিছানায় লেপ্টে আছে। বোনকে খোঁজতে মীম উপরে গিয়ে দেখে মেঘ ঘুমাচ্ছে।  ডাকতে ডাকতে মেঘের ঘুম ভাঙে,


মীম: আপু, ও আপু  উঠো।  এখন ঘুমাচ্ছো কেনো? বাড়িতে মেহমান চলে আসছে।  আজান পরে গেছে অনেকক্ষণ আগে উঠো, নামাজ পরে রেডি হও আম্মু আমায় পাঠাইছে তোমায় ডাকছে। 


কিছুক্ষণ পর মেঘের জ্ঞান ফেরে, পাশের দেয়ালে টানানো দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় ১.১৫ বাজে। তৎক্ষনাৎ শুয়া থেকে উঠে বসে।  আবিরকে কফি দিতে গেছিলো ৮.৩০-৯ টার মধ্যে।   ৪ ঘন্টার উপরে তার জ্ঞান ছিল না।  ৫ মিনিট বসে তারপর গোসলে চলে যায়।  


 নামাজ পরে  আবিরের দেয়া একটা জামা পরে নিলো মেঘ, বেগুনি রঙের গাউন, মোটামুটি গর্জিয়াস ।  চুল গুলো খোঁপা করে নিলো, এত লম্বা চুল  ছেড়ে রাখলে কিছুই করতে পারবে না সে।  মুখে হালকা ফেসপাউডার দিয়ে, গোলাপি রঙের লিপস্টিক দিলো হালকা করে।


রুম থেকে বের হলো প্রায় ৩ টার দিকে। মামা খালারা সবাই খেতে বসেছে৷  ছোটদের খাওয়া শেষ। রুম থেকে বের হয়ে করিডোর দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে সে। বাড়িতে এত হৈ-হুল্লোড়ের শব্দে মাথা ধরে ফেলছে মেঘের।


নজর পরে সোফার দিকে,  আবিরকে ঘেরাও করে বসে আছে সব মামালো খালাতো ভাই বোনরা, তারমধ্যে একজনের দিকে নজর পরে স্পেশাল একজন,   মালা আপুর দিকে, মালা আপু অনার্স ৩য় বর্ষে পড়তেছে এখন, আবির ভাইয়ার মামাতো বোন, মালা আপুর একটা বড় আপুও আছে ওনি  মাইশা৷  ওনার পড়াশোনা শেষ, জব করতেছেন এখন।  দুই বোন ই এসেছেন।   কিন্তু মালা আপুর দৃষ্টি কেমন জানি,  আবির ভাইয়ার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেনো চোখ দিয়েই গিলে খাবে আবির  ভাই কে। বিষয়টা দেখেই মেঘের মেজাজ গরম হয়ে গেছে 


তৎক্ষনাৎ মনে পরে গেলো রাতের কথা, তানভির ভাইয়া তে বলেছিল আবির ভাই এর জীবনে কেউ আছে।  মালা আপুই কি সেই কেউ টা।  ভাবতেই বুক ভরে উঠে কষ্টে। 


আবিরের সমবয়সী একটা ভাইয়া আছে  নাম সাকিব।।  ওনি আবির ভাইয়ার দ্বিতীয় বেস্ট ফ্রেন্ড বলা চলে।  আরও কয়েকটা ছোট ভাই আবির ভাইকে এটা সেটা অনেক কথা জিজ্ঞেস করছে, বিদেশে কেমন লাগে, পড়াশোনা কেমন, কিভাবে থাকতে হয় এসবই।  


মেঘ ধীরস্থির পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে, আবির এক পলক তাকায় সেদিকে পুনরায়  ভাইদের কথায় মনোযোগ দেয়।  


মেঘকে দেখে ২-৪ জন ডাক শুরু করে, এই মেঘ কেমন আছিস, এদিকে আয়।  


মীম ছুটে আসে মেঘের দিকে, 'আপু তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে  মাশাআল্লাহ  নজর না লাগে কারো!'


মেঘ মুচকি হাসলো


মীম মেঘকে টেনে নিয়ে সোফায় বসালো,  সবার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ দৃষ্টি পরে আবির ভাইয়ার দিকে, উপর থেকে সে শুধু মালা আপুর নজর টায় দেখেছে।  এখন  সে আবিরকে দেখছে,  নীল পাঞ্জাবি, সাদা প্যান্ট, মাথায় টুপি আহা কত মায়াবী লাগছে । আবিরের হাস্যোজ্জল মুখটা দেখে  প্রেমে পরে গেছে  মেঘ। যত্রতত্র দৃষ্টি সরিয়ে বাকিদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হলো।


বড়দের খাওয়া শেষ।  মেঘ উঠে সবাইলে সালাম দিয়ে খুশগল্প করতে লাগে, খালামনি দের অনেক দিন পর দেখছে। আগে বিয়েতে গেলে টুকটাক দেখা হতো কিন্তু তানভিরের অত্যাচারে মেয়েটা বিয়ে বাড়িতে যাওয়া ছেড়ে দিছে তাই মামি আর খালাদের সাথে দেখায় হয় না।  মামা অবশ্য মাঝে মাঝে দেখতে আসে, এটা সেটা নিয়ে আসে। 


সারাদিনের ঘুরাঘুরি শেষে সবাই নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।  থাকার জন্য বলেছে সবাই কিন্তু চাকরিজীবীদের কাছে বেড়ানো মানেই কয়েক ঘন্টা ।  


বিদায় বেলায় মালা আপুর আচরণে মাথায় রক্ত উঠে যায় মেঘের, ভালো করে বললেই হয় বেড়াতে যাবেন' গায়ে ঢলে পরার কি আছে আশ্চর্য,  মালার এরকম আচরণে আবির ভাই তৎক্ষনাৎ সরে না গেলে তো উপরে  পরে যেতো এই মেয়ে।  রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মেঘ নিজের রুমে চলে যায়।  


মেহমানদের  বিদায় দিয়ে আবিরও বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরে কোথায় যেনো।মাঝখানে তানভির একবার এসেছিল সবার সাথে দেখা করে আবার বেরিয়ে গেছে। পার্টি অফিসে কি নিয়ে ঝামেলা চলছে তাই বসার সময় হয় নি তার। 


মেঘ নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে লাগলো৷ কিন্তু কেনো কাঁদছে সে নিজেও জানে না ।  অতিরিক্ত রাগে কান্না আসে মেয়েটার। 


চলবে........


📌গল্প কপি করা নিষেধ।  


#ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে অবশ্যই জানাবেন। গল্প রিলেটেড কোনো ধরনের সমস্যা হলে কমেন্ট অথবা ইনবক্সে মেসেজ করবেন।


📌 গল্প কপি করা নিষেধ।  শেয়ার করলে অবশ্যই গল্প কথা পেইজটা ম্যানশন করে দিবেন।

 

Comments

Popular posts from this blog

আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে

আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে